বাংলাদেশে সাদা শেয়াল আর সাদা বাঘ

ভাওয়াল গজারি গড়ের মোক্তারপুর অঞ্চলের কৃষক লোকমান মিয়াজি এক বিকেলে বন থেকে পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছিলেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। হঠাৎ একটু দূরে ঝোপের ভেতর থেকে সাদা রঙের একটি জন্তু বেরিয়ে আসতে দেখলেন মিয়াজি। প্রাণীটাকে ভালো করে লক্ষ করতে তিনি বুঝলেন এটা আসলে ছোট আকৃতির একটি বাঘ। গায়ের রং দুধের মতো ধবধবে সাদা। বাঘটি আস্তে আস্তে গজারিবনের ভেতরে চলে যায়। নিয়াজির বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে, যেন নিজের চোখকে তিনি বিশ্বাস করাতে পারছেন না।

বহুকাল আগের কথা। ভাওয়াল গজারি গড়ের মোক্তারপুর অঞ্চলের স্থানীয় কৃষক লোকমান মিয়াজির মাছ ধরার ভীষণ শখ। তাই তো চার হিসাবে ব্যবহার করার জন্য প্রায়ই বন থেকে পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করে আনেন।

এক বিকেলে বন থেকে পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছিলেন মিয়াজি। সমাগত সন্ধ্যার প্রভাবে চারদিকের আলো দ্রুত কমে আসছিল, তাই জোরে হেঁটে চলেছিলেন তিনি। এ সময় হঠাৎ একটু দূরে ঝোপের ভিতর থেকে সাদা রঙের একটি জন্তুকে বেরিয়ে আসতে দেখেন। প্রাণীটাকে ভালো করে লক্ষ করতে তিনি বুঝলেন এটা আসলে ছোট আকৃতির একটি বাঘ। তার গায়ের রং দুধের মতো ধবধবে সাদা। বাঘটি আস্তে আস্তে গজারিবনের ভেতরে চলে যায়। নিয়াজির বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে, যেন নিজের চোখকে তিনি বিশ্বাস করাতে পারছেন না।

বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ ধরে মিয়াজিরা বসবাস করে আসছেন গজারি বনের পাশে। দাদার কাছে তিনি শুনেছেন গজারি বনের মহিষের গল্প, বাবার কাছে শুনেছেন মানুষখেকো খুনে বাঘের কাহিনি, নিজে বহুবার দেখেছেন গরুখেকো চিতাবাঘ। তবে ধবধবে সাদা কোনো বাঘের গল্প কেউ তাকে শোনায়নি। সাদা জন্তুটা জঙ্গলের ভেতরে চলে যাওয়ার পরও মিয়াজি অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে অন্ধকার। তিনি প্রায় দৌড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।

এরপর কিছুদিনের মধ্যে জঙ্গলের আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক নেমে আসে সেই সাদা প্রাণীটার কারণে। এরই মধ্যে রশিদ নামের এক ব্যক্তি বনের ধারের বিলে রাতের বেলা মাছ ধরতে গেলে সেই সাদা প্রাণীটির মুখোমুখি হন। একে জঙ্গলের ভূত ভেবে লোকটি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরদিন সকালে বনের ধার থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। এতে করে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়।

এবার মিয়াজি ছুটে যান একজন শিকারির কাছে। এই শিকারি প্রায়ই গজারি বনে শিকার করতে আসেন। শিকারিকে এনে সাদা বাঘটিকে মেরে ফেলতে পারলেই সমস্ত ভয় দূর হয়ে যাবে।

শিকারি ছিলেন যথেষ্ট অভিজ্ঞ, অরণ্য আর বন্য প্রাণী সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ছিল তার। তিনি বিষয়টা বুঝতে পারলেন। মিয়াজিকে নিয়ে গজারি বনে গেলেন। সবাইকে খুলে বললেন আসল ঘটনা, এক মুহূর্তে সবার মনের ভয় দূর হয়ে গেল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কী ছিল সেই সাদা জন্তুটির আসল পরিচয়, যে অনেক মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল! আসলে ওটা কোনো বিচিত্র প্রাণী ছিল না, ছিল পূর্ণবয়স্ক সাধারণ মেছো বিড়াল (Fishing cat), অনেকে যাদের মেছো বাঘ বলেও ডাকে।

ওই মেছো বাঘটা এক জন্মগত অসুখে আক্রান্ত ছিল—রোগের নাম ‘অ্যালবিনিজম’। এ হচ্ছে এক ধরনের জন্মগত ব্যাধি, যা প্রাণীদের চুল, নখ ও ত্বককে বিবর্ণ করে দেয়। এভাবেই প্রকৃতির বুকে আসে অ্যালবিনো প্রাণীরা। স্বজাতির থেকে আলাদা ধবধবে ফর্সা এই প্রাণীগুলো শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ কিংবা আলোকচিত্রীদেরও বিশেষ আগ্রহ এবং কৌতূহলের বিষয়।

সংখ্যায় কম হলেও সারা দুনিয়াজুড়ে অ্যালবিনো প্রাণীদের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। যেখানে প্রাণী আছে সেখানেই এরা একটা নির্দিষ্ট সংখ্যায় জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি এদের প্রতি বিশেষ নজর রয়েছে বন্য প্রাণী চোরাচালান সিন্ডিকেটের। কারণ, আন্তর্জাতিক চোরা বাজারে অ্যালবিনো প্রাণীদের রয়েছে বিরাট চাহিদা।

দেড় দশক আগের শ্রীমঙ্গলে শীতেশ বাবুর মিনি চিড়িয়াখানায় একটি সাদা মেছো বাঘ আনা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বন্য প্রাণীপ্রেমী, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ এবং আলোকিত্রীরা ছুটে যান শীতেশ বাবুর বাড়িতে।

বছর চারেক আগে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় যে অ্যালবিনো বাঘের বাচ্চাটি জন্মগ্রহণ করেছিল, তাকে নিয়েও কম আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি। মোটকথা, এরা বরাবরই সাধারণ মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে।

এবার আসি দেশের প্রকৃতির এক অতি সাধারণ বন্য প্রাণীর কথায়, যাকে এখনো অনেক জায়গায়ই কমবেশি দেখতে পাওয়া যায়। সে হচ্ছে শেয়াল (Golden jackal)। শেয়াল দেখেনি এমন মানুষ এখনো দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে সাদা শেয়াল দেখেছে, এমন মানুষ এ দেশে নেই বললেই চলে। যদিও আমাদের প্রকৃতিতে কিন্তু সাদা শেয়ালও আছে। সম্প্রতি বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী আলমাস জামান অতি বিরল এক জোড়া অ্যালবিনো শেয়ালের ছবি ক্যামেরাবন্দী করেছেন।

বন্যপ্রাণীসংশ্লিষ্ট একটি গ্রুপের মাধ্যমে আলোকিত্রী আলমাস জামান প্রথমে সাদা শিয়ালের খবরটি জানতে পান। এ ধরনের সংবাদে যেকোনো ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার উত্তেজিত হয়ে উঠতে বাধ্য। আলমাসের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এরপর এদের অবস্থান খুঁজে বের করার পর শুরু হয় ছবি তোলার চেষ্টা। শেয়ালগুলো তাদের অবস্থান ছেড়ে বের হয় সন্ধ্যার একটু আগে, তখন ছবি তোলার মতো পর্যাপ্ত আলোর অভাব দেখা দেয়। চলে দিনের পর দিন চেষ্টা। এরপর লেন্সবন্দী হয় সাদা শেয়ালের ছবি। আলমাস জামান জানান, সাদা শেয়ালগুলো যেখানে আছে, সেখানকার মানুষ তাদের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। লোকজন এদের রীতিমতো পাহারা দিয়ে রাখে, বিভিন্ন ফার্মের মৃত মুরগিও এনে এদের দেওয়া হয় খাওয়ার জন্য।

দেশের প্রকৃতিতে দেখা যাওয়া সাদা শেয়ালগুলো সম্পর্কে প্রখ্যাত বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ আলী রেজা খান জানান, এই দুর্লভ প্রাণীগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এদের বয়স কম। এদের বাঁচিয়ে রাখতে পারলে প্রকৃতিতে আরও সাদা শেয়াল বেড়ে উঠবে। তবে তিনি আরও জানান, সাদা কিংবা কালো নয়, প্রতিটি বন্য প্রাণীই প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ। যত দিন পর্যন্ত আমরা এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারব, তত দিন নিজেদের সভ্য জাতি বলে দাবি করার অধিকার নেই।