যে পরিমান অন্যায় নির্যাতন করেছেন হাসিনা, কতদিন সাজা হতে পারে জানা গেল

নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিপরিষদ এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারাদেশে একের পর এক মামলা হচ্ছে। এ পর্যন্ত অন্তত ১৪২টি মামলা হয়েছে। গত ১৩ আগস্ট থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ২৫ দিনে আদালত ও থানায় এসব মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে ১২৬টি। গড়ে প্রতিদিন পাঁচটি। এ ছাড়া অপহরণ, হত্যাচেষ্টা ও সহিংসতার মামলায় শেখ হাসিনাকে ‘নির্দেশদাতা-হুকুমদাতা-পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে প্রধান আসামি করা হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গাজীপুরে দুটি হত্যা মামলা হয়েছে।

এখন পর্যন্ত এসব মামলায় নাম উল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ৪ হাজার ৬০০ ছাড়িয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে শত শত অজ্ঞাত আসামি। তবে মামলাগুলোর উপাদান বা মেরিট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যেভাবে পাইকারি হারে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়েছে, তাতে হয়রানি ছাড়া আর কিছুই হবে না। এগুলোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তিন দিন পর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।

সরকার পতনের পর করা মামলাগুলোতে শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল, সাবেক স্পিকার, সাবেক মন্ত্রী, এমপি, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, র‌্যাব কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, ১৪ দলের নেতা, আইনজীবী, অভিনেতা, খেলোয়াড়, প্রবাসীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। মামলাগুলোতে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছে। অধিকাংশ মামলার এজাহারের বর্ণনা কাছাকাছি ভাষায়।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইকারি হারে আসামি করে মামলার ফলাফল খুব ভালো হবে না। কারণ, এত সংখ্যক আসামির বিরুদ্ধে তদন্তের ভিত্তিতে অপরাধ প্রমাণ করতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এতে আন্দোলনে হতাহতের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে কিনা, সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।

সাহায্যের নাম করে দস্তখত নিয়ে মামলা
অভিযোগ উঠেছে, বেশ কিছু মামলায় ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক স্বার্থ, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছাড়াও হীন উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা হয়েছে। পুরোনো রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা উল্লেখ করেও মামলা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি হয় গত ১৩ আগস্ট ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় পুলিশের গুলিতে মুদি দোকানের মালিক আবু সায়েদের মৃত্যুর ঘটনায় করা ওই মামলায় শেখ হাসিনাসহ সাতজনকে আসামি করা হয়।
মামলার বাদী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এসএম আমীর হামজা শাতিল সমকালকে বলেন, বিবেকের তাড়নায় তিনি মামলা করেছেন।

গত ২০ আগস্ট সিলেটের বিয়ানীবাজার থানায় একটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে ৯ প্রবাসী, ছয় সাংবাদিক ও আওয়ামী লীগের ৭৫ নেতাকর্মীকে। মামলার বাদী দেখানো হয় নিহত তারেক আহমদের মা ইনারুন নেছাকে। তিনি বলেন, ‘আসামিরা আমার পূর্বপরিচিত। তবে তারা হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। একদল লোক এসে আমার মৃত ছেলের জন্য সাহায্যের নাম করে সাদা কাগজে দস্তখত নিয়ে এই মামলা করেছে।’
ফৌজদারি মামলা বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, যে হত্যা মামলাগুলো করা হয়েছে, তা অতীতে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে নেওয়া প্রতিশোধের কথা মনে করিয়ে দেয়।

মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার
হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, আমার কাছে মনে হয় না, এসব মামলা পুলিশ সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবে। অথচ পুলিশ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিচার হয়ে থাকে। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্যপ্রমাণ না পাওয়া গেলে আদালত কীভাবে বিচার করবেন?
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর মধ্যে ১১টি গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। গত ১৪ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত ‘গণহত্যা’র বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয়।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক মনে করেন, এসব মামলার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এভাবে পাইকারি হারে কোনো ফৌজদারি মামলা হয় না। একটা মামলায় ৩০০-৪০০ আসামি হলে মামলার গুরুত্ব অনেকাংশে কমে যায়।
ভুলভাবে মামলা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, আগে যেভাবে মামলা হতো, সেভাবে এখন বিএনপি নেতাদের জায়গায় শুধু আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণ করার পরে শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, পুলিশ অফিসার এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা তদন্তকারীদের পক্ষে খুব কঠিন হবে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না সমকালকে বলেন, বর্তমান সরকারের এক মাসেই এ অবস্থা, বাকি দিন কী হবে তা বোঝা যাচ্ছে। এসব মামলা ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না

তিনি আরও বলেন, রাজনীতিবিদ ও তাদের সহযোগীদের বানোয়াট মামলায় গ্রেপ্তার করলে মামলার কোনো ফল হবে না, যেমনটি আওয়ামী লীগ সরকার করেছে। হয়রানির রেজাল্ট ভালো হয় না, পর্যায়ক্রমে বুঝবে সরকার।
জেড আই খান পান্না বলেন, গত ৫ আগস্ট আদাবর এলাকায় পোশাককর্মী রুবেলকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান হত্যার সময় দেশে ছিলেন না। এখন আমি ছাড়া কেউই মামলার আসামি বাদ পড়ছে না, এটা কি আইনের শাসন?

তিনি বলেন, হয়রানি করার জন্যই এসব মামলা হচ্ছে, যা এই সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করবে। এর মাধ্যমে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে ভিকটিমের পরিবারের প্রতি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, এভাবে মামলা করলে প্রত্যাশিত বিচার হবে না। আমরা চাই প্রতিটি হত্যার জন্য প্রকৃত অপরাধীদের বিচার হোক। এভাবে মামলা করলে প্রকৃত আসামিরা ছাড়া পেয়ে যেতে পারে।

তিনি বলেন, সরকারই ইতোমধ্যে সার্কুলার দিয়ে ঘোষণা করেছে, এসব মামলার গ্রহণযোগ্যতা নেই। দুর্বল তথ্য, দুর্বল সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে করা মামলাগুলো ‘আস্থার সংকট’ তৈরি করবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, ঢালাওভাবে আসামি করে মামলা দায়ের কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি অনৈতিক ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। প্রকৃত ঘটনা নিরূপণ করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা এবং নির্দোষ ব্যক্তিকে হয়রানির হাত থেকে মুক্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সব অংশীজনের দায়িত্ব।