বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে কিছু দূর গেলে হাতের ডান দিকে যমুনা নদীর পাড়ে বসানো হয়েছে সারি সারি সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। বছরের বেশিরভাগ সময় পানি জমে থাকা প্রায় অব্যবহৃত এ জমিতে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে নির্মিত হচ্ছে ৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। সূর্যের আলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি এখানে হাঁস, মাছ এবং সবজি চাষের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ-চায়না রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেডের উদ্যোগে নির্মাণাধীন কেন্দ্রটি আগামী মে মাসে উৎপাদনে যাবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা।
এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত বিশ্বে কৃষিজমিকে বাঁচিয়ে এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশেও ব্যাপকভাবে এটি করা হলে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার দ্রুত বেড়ে যাবে।
বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে সয়দাবাদ এলাকায় ২১৪ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সমান মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)। ৮৭ দশমিক ৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (ডলারের বিনিময় হার ১০৫ টাকা হিসাবে প্রায় ৯২১ কোটি টাকা) ব্যয়ে কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী, ২০ বছরের জন্য কেন্দ্রটি থেকে ইউনিটপ্রতি ১০ দশমিক ২ সেন্ট বা প্রায় ১১ দশমিক ২২ টাকা (ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা হিসাবে) হারে বিদ্যুৎ কিনবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
তারা আরও জানান, এর আগে যমুনার তীরে সয়দাবাদ এলাকায় ৬ দশমিক ৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। সেখানে সোলার প্যানেলের নিচে টমেটো, কুমড়া, কচু, পুঁইশাকসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করা হচ্ছে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে এটি বাস্তবায়ন করেছিলেন এনডব্লিউপিজিসিএলের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ-চায়না রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিআরইসিএল) এমডি। আগের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি কীভাবে আরও বহুমুখী ব্যবহার করা যায়, সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
জানতে চাইলে বিসিআরইসিএলের এমডি প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সোলার প্যানেলগুলো উঁচু করে এবং দুই সারির মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা রেখে এমনভাবে বসানো হয়েছে যাতে ভেতর দিয়ে নৌকা চলাচল করতে পারে এবং নিচে যেন সূর্যের আলো পৌঁছায়। ফলে মাছ, হাঁস এবং সবজিজাতীয় ফসল চাষ করা যাবে সেখানে। এমনিতেই ওই জায়গায় আগে তেমন একটা ফসল হতো না। সেই জায়গাটা কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি মৎস্য চাষ ও কৃষিকাজে ব্যবহারের ফলে বহুমুখী সুবিধা মিলবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ রকম চ্যালেঞ্জিং জায়গার মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশে আর কেউ করছে বলে আমার জানা নেই। ইনশা আল্লাহ কেন্দ্রটি অনেক সুন্দর হবে। এটা যেন পর্যটকদেরও আকৃষ্ট করে, সেই চিন্তা করা হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ৩ হাজার মেগাওয়াট প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমোদন পেয়েছে বিসিআরইসিএল। আমরা আশা করছি, যথাসময়েই সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে।’
খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় ধারণা করা হতো, সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে বিশাল জায়গা লাগে এবং সেই জমি অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এখন জমির পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। সেই সঙ্গে জমির বহুমুখী ব্যবহারও করা হচ্ছে।
এনডব্লিউপিজিসিএলের প্রধান প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, ভূমি থেকে প্রায় ১০ ফুট উঁচু পিলারের ওপর সোলার প্যানেলগুলো বসানো হয়েছে। এমন ২৭ হাজার সুউচ্চ পিলারের ওপর বসানো হবে ৫৪৫ ওয়াটপিক ক্ষমতার ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৭৬টি প্যানেল। যার মোট ক্ষমতা ৮৫ দশমিক ৩৩ মেগাওয়াট। এখান থেকে ৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।
এনডব্লিউপিজিসিএলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মোহাইমেনুল ইসলাম বলেন, ‘এটি শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি স্থানীয় আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নেও কেন্দ্রটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য কেন্দ্রের চেয়ে এটি কিছুটা ব্যতিক্রম হবে বলে আমরা আশা করছি।’
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. তানবীর রহমান বলেন, ‘আগামী এপ্রিলের শেষ দিকে সবগুলো সোলার প্যানেল স্থাপন ও অন্যান্য কাজ শেষ হবে আশা করছি। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজও শেষ পর্যায়ে। সবকিছু ঠিক থাকলে মে মাস থেকে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।’
গবেষণা ও পরামর্শ সেবা প্রতিষ্ঠান ‘চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের’ প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে বিশ্ব এখন এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে জমি কোনো ফ্যাক্টর নয়। সদিচ্ছাই এখানে মুখ্য বিষয়। সিরাজগঞ্জে ৬৮ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে হাঁস, মাছ ও ফসল চাষের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। এভাবে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হলে জমি নষ্ট হবে না। এতে দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার হবে। অন্যান্য সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পেও যাতে এমন পরিকল্পনা নেওয়া হয়, সে জন্য সরকারকে আরও উদ্যোগী হওয়া দরকার।’
দেশে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের সঙ্গে সমান অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিসিআরইসিএল নামে কোম্পানি গঠন করে সরকার। প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দ্রুততম সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্ক বিসিআরইসিএলের প্রথম বিদ্যুৎ প্রকল্প। এ প্রকল্পে ইপিসি ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে চীনা কনসোর্টিয়াম অব প্যারিওশেন-ফেডি-সিনোহাইড্রো। কারিগরি পরামর্শক হিসেবে রয়েছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান জেডটেনকো লিমিটেড।
সিরাজগঞ্জের পাশের জেলা পাবনায় ৬৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরও একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ চলছে। বিসিআরইসিএলের ওই কেন্দ্রটি থেকেও চলতি বছরের শেষ দিকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া পটুয়াখালীর পায়রায় ৫০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পসহ আরও কয়েকটি নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়েছে বিসিআরইসিএল।